প্রসব পরবর্তী সময়ে অনেক মায়ের জন্য একটি সাধারণ, কিন্তু কষ্টকর সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় পাইলস বা হেমোরয়েডস (Hemorrhoids)। এটি মূলত এমন একটি অবস্থা যেখানে রেকটামের আশেপাশের শিরাগুলি ফুলে যায় এবং ব্যথা, জ্বালা, ও অস্বস্তির সৃষ্টি করে। অনেক ক্ষেত্রে, এটি গর্ভাবস্থার সময় বা প্রসবের পর হয়ে থাকে। সঠিক চিকিৎসা এবং কিছু সহজ ঘরোয়া প্রতিকার ব্যবহার করে আপনি এই সমস্যার থেকে মুক্তি পেতে পারেন।
পাইলস কী?
পাইলস বা হেমোরয়েডস হলো পেটের নীচের অংশে অবস্থিত শিরাগুলির অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। এটি অন্ত্রের ভেতরে বা বাইরের দিকেও হতে পারে। প্রসবের পর মহিলাদের মধ্যে হরমোনাল পরিবর্তনের কারণে, পাইলসের সমস্যা আরও বাড়তে পারে।
লক্ষণ:
- মলত্যাগের সময় ব্যথা
- পায়খানা করার পরে রক্ত দেখা
- পায়খানার সময় অস্বস্তি বা চাপ অনুভব
- মলদ্বারের আশেপাশে স্ফীতি বা শিরাগুলির দৃশ্যমান বৃদ্ধি
প্রসব পরবর্তী পাইলসের কারণ:
প্রসব পরবর্তী সময়ে পাইলসের সমস্যার কিছু সাধারণ কারণ রয়েছে:
- গর্ভাবস্থার সময় চাপ: গর্ভধারণের সময় শিরাগুলিতে অতিরিক্ত চাপ পড়ে, যা পাইলস সৃষ্টি করতে পারে।
- প্রসবের সময়: সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় অত্যাধিক চাপ বা সিজারিয়ান অপারেশন পাইলস সৃষ্টি করতে পারে।
- হরমোনাল পরিবর্তন: গর্ভাবস্থায় এবং প্রসবের পরে হরমোনের পরিবর্তন, বিশেষ করে প্রোজেস্টেরন হরমোনের কারণে শিরাগুলির প্রসারণ হতে পারে।
- অনিয়মিত মলত্যাগ: কোষ্ঠকাঠিন্য বা কঠিন মল তৈরি হলে মলদ্বারে চাপ পড়তে পারে, যা পাইলসের সৃষ্টি করতে সহায়তা করে।
- অতিরিক্ত ওজন: প্রসবের পরে অতিরিক্ত ওজন বেড়ে যাওয়ার কারণে পাইলস হতে পারে।
প্রসব পরবর্তী পাইলসের জন্য ঘরোয়া প্রতিকার
যেহেতু পাইলসের চিকিৎসা প্রাথমিকভাবে ঘরোয়া উপায়ে করা যায়, এখানে কিছু কার্যকর এবং সহজ ঘরোয়া চিকিৎসা দেওয়া হলো, যা প্রসব পরবর্তী পাইলসের উপশমে সহায়তা করবে।
১. গরম পানির সিটস ব্যাথা (Warm Water Sitz Bath)
গরম পানির সিটস ব্যাথা পাইলসের ব্যথা কমাতে সহায়ক একটি প্রাচীন এবং কার্যকরী পদ্ধতি। এতে রক্ত চলাচল বাড়ে এবং শিরাগুলির স্বাভাবিক আকারে ফিরে আসার প্রক্রিয়া দ্রুত হয়।
প্রস্তুত প্রণালী:
- একটি বেসিনে গরম পানি নিয়ে তাতে কিছু লবণ মিশিয়ে নিতে পারেন।
- এতে ১৫-২০ মিনিট বসে থাকুন।
- এটি দিনে ২-৩ বার করলে পাইলসের ব্যথা অনেক কমে যাবে।
২. পেটের ভ্যাসেলাইন ব্যবহার (Petroleum Jelly or Vaseline)
পেটের ভ্যাসেলাইন বা পেট্রোলিয়াম জেলি পাইলসের ব্যথা ও চুলকানি কমাতে সহায়ক। এটি মলদ্বারের আশেপাশের শিরাগুলির শুষ্কতা এবং চামড়া ফেটে যাওয়ার সমস্যাকে দূর করে।
প্রস্তুত প্রণালী:
- প্রতিদিন রাতে মলদ্বারের চারপাশে কিছু পরিমাণ ভ্যাসেলাইন লাগান।
- এটি মলদ্বারের শিরাগুলির সুরক্ষা প্রদান করবে এবং ব্যথা কমাবে।
৩. আলোভেরা (Aloe Vera)
আলোভেরা পাইলসের সমস্যার জন্য খুবই কার্যকর। এটি প্রাকৃতিক অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি উপাদান হিসেবে কাজ করে এবং পাইলসের ব্যথা, চুলকানি ও ফোলাভাব কমাতে সাহায্য করে।
প্রস্তুত প্রণালী:
- তাজা আলোভেরা জেল সরাসরি পাইলস আক্রান্ত স্থানে লাগান।
- এটি ১০-১৫ মিনিটের জন্য রেখে দিন, তারপর ধুয়ে ফেলুন।
৪. ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার (High-fiber foods)
ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার কোষ্ঠকাঠিন্য রোধ করতে সহায়ক, যা পাইলসের সমস্যা কমাতে সাহায্য করে। দিনে পর্যাপ্ত পরিমাণে ফলমূল, শাক-সবজি, এবং দানাদার খাবার খান।
প্রস্তাবিত খাবার:
- সবজি, ফল, ডাল, বাদাম, ওটস, এবং গোটা শস্য।
- পর্যাপ্ত পরিমাণে জল পান করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৫. ক্যামোমাইল চা (Chamomile Tea)
ক্যামোমাইল চা একটি প্রাকৃতিক উপাদান, যা মলদ্বারের স্ফীতি এবং ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। এটি শিরাগুলিকে শিথিল করতে সহায়তা করে এবং পাইলসের জ্বালাও কমায়।
প্রস্তুত প্রণালী:
- এক কাপ গরম পানিতে ক্যামোমাইল ফুল যোগ করুন।
- কিছুক্ষণ পর তা পান করুন।
৬. হালকা ব্যায়াম (Light Exercise)
পাইলসের সমস্যায় আক্রান্ত হলে শারীরিক পরিশ্রম না করাই ভালো, তবে কিছু হালকা ব্যায়াম যেমন হাঁটা বা যোগব্যায়াম করতে পারেন। এটি পেটের রক্তচলাচল উন্নত করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।
৭. পিপারমিন্ট তেল (Peppermint Oil)
পিপারমিন্ট তেল একটি প্রাকৃতিক অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি উপাদান, যা পাইলসের ব্যথা ও অস্বস্তি কমাতে সাহায্য করে। এটি শিরাগুলিকে শিথিল করে এবং সঞ্চালন বৃদ্ধি করে।
প্রস্তুত প্রণালী:
- কিছু পিপারমিন্ট তেল একটি বেস তেলে মিশিয়ে মলদ্বারের আশেপাশে ম্যাসাজ করুন।
পাইলস থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায়
১. পর্যাপ্ত পানি পান করুন
পানি পান কোষ্ঠকাঠিন্য রোধ করে এবং পাইলসের সমস্যা কমায়। প্রতিদিন অন্তত ৮-১০ গ্লাস পানি পান করার চেষ্টা করুন।
২. চাপ থেকে বিরত থাকুন
যতটা সম্ভব প্রসবের পর শারীরিকভাবে চাপ প্রয়োগ করা থেকে বিরত থাকুন। এতে পাইলসের সমস্যা বাড়তে পারে।
৩. নিয়মিত হালকা ব্যায়াম করুন
ব্যায়াম পেটের মাংসপেশী শিথিল রাখে এবং রক্তচলাচল বাড়ায়, যা পাইলসের সমস্যা কমাতে সহায়ক।
ডাক্তারের পরামর্শ
যদি পাইলসের সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হয় বা ব্যথা তীব্র হয়, তাহলে একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। কিছু ক্ষেত্রে, পাইলসের জন্য অস্ত্রোপচার বা অন্যান্য চিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে।
প্রসব পরবর্তী পাইলস একটি সাধারণ সমস্যা, তবে ঘরোয়া চিকিৎসা ও পরিস্কার জীবনযাপন অনুসরণ করলে এই সমস্যার উপশম সম্ভব। তবে, যদি সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।