বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে দীর্ঘদিনের ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও ভৌগোলিক সম্পর্ক বিদ্যমান। দুই দেশ পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে তাদের উন্নয়ন এবং নিরাপত্তার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। তবে, যদি বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক অবনতি ঘটে, তাহলে বাংলাদেশ শুধু হারাবে। কেন এটি সত্য, সেই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
১. অর্থনৈতিক সহযোগিতা
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি:
ভারত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদারদের একজন। ভারত থেকে আমদানি এবং ভারতে রপ্তানি—দুই ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের অর্থনীতি সরাসরি লাভবান হচ্ছে। ২০২২ সালে ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল প্রায় ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যদি সম্পর্কের অবনতি ঘটে, তবে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হবে, যা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
ভারতীয় বিনিয়োগ:
ভারতের বহু সংস্থা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে আসছে, যা কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং শিল্পায়নে সহায়ক। যদি সম্পর্ক খারাপ হয়, তবে ভারতীয় বিনিয়োগকারী সংস্থাগুলি বাংলাদেশ থেকে তাদের বিনিয়োগ তুলে নিতে পারে বা কমিয়ে দিতে পারে। এর ফলে বাংলাদেশের শিল্প ও কর্মসংস্থানে বড় ধরনের ধাক্কা লাগবে।
২. জ্বালানি ও পরিবহন সুবিধা
জ্বালানি নিরাপত্তা:
ভারত বাংলাদেশকে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ করে থাকে। বিশেষ করে, বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যকার বিদ্যুৎ বিনিময় চুক্তি বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। যদি সম্পর্ক খারাপ হয়, তাহলে জ্বালানি সরবরাহে বিপর্যয় দেখা দিতে পারে, যা বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ঘাটতি বাড়িয়ে তুলতে পারে এবং শিল্প উৎপাদন থেমে যেতে পারে।
পরিবহন সুবিধা:
ভারতের পূর্বাঞ্চল দিয়ে বাংলাদেশ তার পণ্য এবং যাত্রী পরিবহনে সুবিধা পেয়ে থাকে। বিশেষ করে উত্তর-পূর্ব ভারতের সাথে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে সরাসরি ট্রানজিট চুক্তি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সুবিধা নিশ্চিত করেছে। সম্পর্ক অবনতির ফলে এই ধরনের ট্রানজিট সুবিধাগুলি বন্ধ হয়ে যেতে পারে, যা বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি খরচ বাড়িয়ে তুলবে।
৩. কৌশলগত এবং নিরাপত্তা সহযোগিতা
সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধ:
দুই দেশের মধ্যে কৌশলগত সহযোগিতা বিশেষত সীমান্ত নিরাপত্তা এবং সন্ত্রাসবাদ দমনে গুরুত্বপূর্ণ। ভারত এবং বাংলাদেশ একে অপরের সঙ্গে তথ্য বিনিময় করে এবং সীমান্তবর্তী অঞ্চলে আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সহযোগিতা করে। যদি সম্পর্ক খারাপ হয়, তবে সীমান্তবর্তী এলাকায় সন্ত্রাসবাদ এবং অবৈধ কর্মকাণ্ড বাড়তে পারে, যা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তায় সংকট সৃষ্টি করবে।
ভূরাজনৈতিক অবস্থান:
ভারত বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী শক্তিশালী দেশ, এবং বাংলাদেশ-ভারত কৌশলগত অংশীদারিত্ব দেশের ভূরাজনৈতিক স্থিতি মজবুত করে। যদি এই সম্পর্ক অবনতি ঘটে, তবে বাংলাদেশ তার আঞ্চলিক স্থিতি দুর্বল করতে পারে, এবং বৃহত্তর শক্তি যেমন চীন বা পাকিস্তানের ওপর নির্ভরশীল হতে পারে। এটি বাংলাদেশের স্বার্থের পরিপন্থী হতে পারে, কারণ ভারসাম্যহীন কৌশলগত সম্পর্ক দেশের স্বাধীন নীতি গঠনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে।
৪. জলবণ্টন এবং পরিবেশগত চুক্তি
তিস্তা চুক্তি এবং অন্যান্য নদী চুক্তি:
বাংলাদেশে পানি সংকট এবং নদীর ওপর নির্ভরশীলতা অনেক বেশি। ভারত ও বাংলাদেশ তিস্তা এবং অন্যান্য নদীর পানি ভাগাভাগির জন্য আলোচনা চালিয়ে আসছে। সম্পর্কের অবনতি হলে এসব চুক্তি বিলম্বিত বা ব্যাহত হতে পারে, যা বাংলাদেশের কৃষি এবং জলের নিরাপত্তার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলবে।
পরিবেশগত সংকট:
দুই দেশের পরিবেশগত চ্যালেঞ্জগুলোও মিলিতভাবে মোকাবিলা করা হয়, যেমন নদী দূষণ, বন উজাড় এবং জলবায়ু পরিবর্তন। সম্পর্ক খারাপ হলে এই ধরনের আন্তঃসীমান্ত পরিবেশগত সমস্যাগুলি সমাধানে বাধা সৃষ্টি হবে।
৫. সাংস্কৃতিক এবং জনগণের সম্পর্ক
সাংস্কৃতিক সম্পর্ক:
বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে দীর্ঘদিনের সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান রয়েছে। দুই দেশের মানুষের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে যা কেবল বাণিজ্যিক বা রাজনৈতিক নয়, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বন্ধনের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। সম্পর্ক অবনতির ফলে এই পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং সংস্কৃতির বিনিময়ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যা দুই দেশের জনগণের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করতে পারে।
উপসংহার
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের অবনতি শুধু অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক, কৌশলগত এবং পরিবেশগত দিক থেকেও বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর হবে। শক্তিশালী এবং স্থিতিশীল সম্পর্কের মাধ্যমেই দুই দেশ পারস্পরিক লাভবান হতে পারে। তাই, সম্পর্ক রক্ষা করা এবং উন্নত করা বাংলাদেশের স্বার্থে অত্যন্ত জরুরি।