জাস্টিন ট্রুডো, কানাডার প্রধানমন্ত্রী, গত কিছু সময় ধরে ভারতের বিরুদ্ধে একের পর এক মন্তব্য করে আসছেন। বিশেষ করে খালিস্তানপন্থী সমর্থকদের প্রতি তার নরম অবস্থান ও ভারতের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মঞ্চে সমালোচনা অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। কেন তিনি ভারতের বিরুদ্ধে এত সরব? তার পেছনে আসলেই কী রাজনৈতিক উদ্দেশ্য লুকিয়ে আছে? চলুন, এই বিষয়টি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা যাক।
১. খালিস্তানপন্থী সমর্থক এবং ট্রুডোর ভোটব্যাংক
কানাডায় একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিখ জনগোষ্ঠী বসবাস করে, যাদের মধ্যে খালিস্তানপন্থী আন্দোলনের সমর্থকরা রয়েছে। ট্রুডোর দল, লিবারেল পার্টি, প্রায়ই এই শিখ সম্প্রদায়ের সমর্থন পেতে সচেষ্ট থাকে, কারণ তারা কানাডার ভোটব্যাংকে একটি শক্তিশালী অংশ।
ভোটব্যাংকের হিসাব:
কানাডার অনেক প্রদেশে শিখ ভোটাররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ট্রুডোকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে এই ভোটব্যাংক অত্যন্ত জরুরি। ভারতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে এবং খালিস্তানপন্থীদের বিষয়ে কোনো কঠোর পদক্ষেপ না নিয়ে ট্রুডো এই সমর্থন ধরে রাখার চেষ্টা করছেন।
২. অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং বহুজাতিকতার প্রচার
ট্রুডোর সরকার বহুজাতিক সংস্কৃতিকে সমর্থন করে, যেখানে বিভিন্ন জাতি, ধর্ম, এবং সংস্কৃতির মানুষকে তাদের নিজস্ব পরিচয় নিয়ে বসবাস করার অধিকার দেওয়া হয়। এই নীতির মাধ্যমে তিনি কানাডার শিখ সম্প্রদায়ের স্বাধীন মতামত ও বিশ্বাসের অধিকারে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন, যা ভারতের সরকার ও ট্রুডোর মধ্যে সংঘাতের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বহুজাতিকতার প্রচার এবং এর রাজনৈতিক প্রভাব:
কানাডার অভ্যন্তরে এই নীতি ট্রুডোর জন্য রাজনৈতিক সুবিধা বয়ে আনে। বহুজাতিকতার নামে ট্রুডো বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সমর্থন পান, যার মধ্যে খালিস্তানপন্থী শিখ সম্প্রদায় একটি বড় অংশ। তবে এই নীতির কারণে ট্রুডো ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে প্রয়োজনীয় নমনীয়তা দেখাতে ব্যর্থ হচ্ছেন।
৩. ভারতের বিরুদ্ধে মানবাধিকার নিয়ে প্রশ্ন তোলা এবং আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি
ট্রুডো তার রাজনৈতিক অবস্থানকে আরো শক্তিশালী করতে প্রায়শই ভারতের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেন। আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার বিষয়ে সমালোচনা করে তিনি একদিকে শিখ সম্প্রদায়ের সমর্থন অর্জন করেন এবং অন্যদিকে নিজের “মানবাধিকার রক্ষক” ভাবমূর্তি তৈরি করেন।
আন্তর্জাতিক মঞ্চে সমালোচনা:
ট্রুডো বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে ভারতের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এর ফলে কানাডার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক মহলে তার ভাবমূর্তি উন্নত হয় এবং আন্তর্জাতিক মহলেও নিজেকে একটি নৈতিক রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে প্রমাণ করার সুযোগ পান।
৪. বাণিজ্যিক এবং অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রভাব
ভারত-কানাডা সম্পর্ক শুধুমাত্র রাজনৈতিক নয়, বরং বাণিজ্যিক ক্ষেত্রেও প্রভাবিত হয়। ট্রুডো ভারতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে কানাডায় স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সমর্থন পেতে পারেন, যারা ভারতীয় বাজারের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় রয়েছে। এছাড়া, ট্রুডো চীনের সাথে কানাডার বাণিজ্য সম্পর্ক জোরদার করতে পারেন ভারতের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে।
অর্থনৈতিক অগ্রাধিকার:
ট্রুডো চীনের মতো বৃহৎ বাণিজ্যিক অংশীদারের সাথে সম্পর্ক শক্তিশালী করতে চান। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত হলে চীনের সাথে সম্পর্ক কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এজন্যই ভারতের সাথে সম্পর্কের ঝুঁকি নিয়ে তিনি নিজের অর্থনৈতিক এজেন্ডাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন।
৫. ট্রুডোর রাজনৈতিক কৌশল এবং নিজ দলের অভ্যন্তরীণ চাপ
কানাডায় শিখ সম্প্রদায়ের নেতারা প্রায়ই খালিস্তানপন্থীদের অধিকার এবং মতামতকে প্রকাশ্যে সমর্থন করেন। ট্রুডোর দলেও অনেক প্রভাবশালী শিখ নেতা রয়েছেন, যারা ট্রুডোর ওপর প্রভাব বিস্তার করেন। তাদের প্রভাবের কারণেও ট্রুডো ভারতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে বাধ্য হন।
দলীয় অভ্যন্তরীণ চাপ:
ট্রুডোর দলীয় নেতাদের মধ্যে অনেকেই ভারতের বিরোধিতা করে। ফলে, ট্রুডো তার দলের মধ্যে সমর্থন বজায় রাখতে এবং তাদের রাজনৈতিক চাপ সামলাতে ভারতের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান বজায় রাখেন।
৬. কৌশলগত জোট এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি
পশ্চিমা দেশগুলি প্রায়ই একে অপরের মধ্যে সহযোগিতা বজায় রেখে বৃহত্তর রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন করতে চায়। ট্রুডোর ভারতবিরোধী অবস্থান অনেকাংশে পশ্চিমা দেশের সাথে কৌশলগত জোটের একটি অংশ বলেও ধারণা করা হয়।
পশ্চিমা প্রভাব ও রাজনৈতিক সখ্য:
ট্রুডো পশ্চিমা রাজনৈতিক শক্তিগুলির সাথে মিল রেখে ভারতের বিরুদ্ধে সমালোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। এর মাধ্যমে তিনি আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান মজবুত করতে চান।
উপসংহার
জাস্টিন ট্রুডোর ভারতের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার পেছনে কয়েকটি সুস্পষ্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে। তার মধ্যে ভোটব্যাংকের সমর্থন, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপ, বহুজাতিক সংস্কৃতি প্রচারের নীতি, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংক্রান্ত ভাবমূর্তি, এবং কৌশলগত জোটের প্রভাব অন্যতম। এই কারণগুলো বিবেচনায় রেখে বলা যায়, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক তিক্ত করেও ট্রুডো নিজের রাজনৈতিক স্বার্থে এগিয়ে যাচ্ছেন। তবে এটি দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।