অস্ট্রিয়া, ইউরোপের একটি প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক মণিকোঠা, যেখানে প্রাচীন স্থাপত্য, অসাধারণ প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং অসাধারণ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সমন্বয় ঘটেছে। এই নিবন্ধটি আমি প্রস্তুত করেছি বাংলাদেশ এবং ভারত থেকে ভ্রমণ করতে ইচ্ছুকদের জন্য একটি সম্পূর্ণ পর্যটন গাইড হিসেবে। আপনারা যারা অস্ট্রিয়ার লোভনীয় আলপস পর্বতমালা, ঐতিহাসিক শহর এবং অপেরা হলসমূহ আবিষ্কার করতে চান, তাদের জন্য এটি একটি দারুণ সহায়ক প্রমাণিত হবে।
বাংলাদেশ এবং ভারত থেকে অস্ট্রিয়া ভ্রমণের প্রস্তুতি
ভিসা প্রক্রিয়া
শেঙ্গেন অঞ্চলের অংশ হওয়ায় অস্ট্রিয়া ভ্রমণে বাংলাদেশ ও ভারতের নাগরিকদের শেঙ্গেন ভিসা প্রয়োজন। সাধারণত ভিসার আবেদন প্রক্রিয়া সহজ হলেও, ভিসা প্রাপ্তির সময় নির্দিষ্ট কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়।
- আবেদন প্রক্রিয়া:
- পাসপোর্টের বৈধতা এবং প্রয়োজনীয় ভিসা ফি জমা দিয়ে আবেদন জমা দিন।
- বিমানের টিকিট এবং হোটেল বুকিংয়ের কপি ভিসা আবেদনের সময় জমা দিতে হয়।
- ভ্রমণের নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য উল্লেখ করতে হয়, যাতে বুঝা যায় কেন আপনি শেঙ্গেন অঞ্চলে যেতে চান।
- অন্যান্য আবশ্যক কাগজপত্র, যেমন ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট, চাকরির সার্টিফিকেট, ইত্যাদি লাগতে পারে।
ফ্লাইট এবং পরিবহন ব্যবস্থা
বাংলাদেশ থেকে ভ্রমণ
ঢাকা থেকে সরাসরি ভিয়েনা বা সালজবার্গে সরাসরি ফ্লাইট না থাকায় ট্রানজিটের মাধ্যমে যেতে হবে। কাতার এয়ারওয়েজ, এমিরেটস এবং তুর্কিশ এয়ারলাইন্স বিভিন্ন ট্রানজিট পয়েন্টের মাধ্যমে ঢাকাকে অস্ট্রিয়ার সাথে সংযুক্ত করে। ভ্রমণ সময় এবং ট্রানজিট পয়েন্টগুলি ফ্লাইট নির্বাচন করার সময় বিবেচনায় রাখতে হবে।
ভারত থেকে ভ্রমণ
দিল্লি, মুম্বাই, চেন্নাই এবং বেঙ্গালুরু থেকে ভিয়েনা এবং সালজবার্গে সরাসরি ফ্লাইট পাওয়া যায়। এয়ার ইন্ডিয়া এবং লুফথানসা এয়ারলাইন্সে সরাসরি ফ্লাইট পাওয়া যায়, যা যাত্রাকে অনেকটাই সহজ করে তোলে। এটি আপনাকে আরও সাশ্রয়ী এবং সময় বাঁচাতে সাহায্য করবে।
ভ্রমণের সেরা সময়
- গ্রীষ্মকাল (মে-আগস্ট): যারা হাইকিং, আউটডোর ভ্রমণ এবং শহরগুলির জীবনযাত্রা উপভোগ করতে চান তাদের জন্য গ্রীষ্মকাল আদর্শ।
- শীতকাল (নভেম্বর-মার্চ): শীতে বরফে ঢাকা আল্পসের দৃশ্য অসাধারণ। সালজবার্গ এবং ইন্সব্রুকে স্কিইংয়ের জন্য এই সময়টা খুবই উপযোগী।
টিকিট বুকিং ও যাতায়াতের খরচ পরিকল্পনা
অস্ট্রিয়া ভ্রমণের প্রস্তুতির ক্ষেত্রে টিকিট বুকিং এবং যাতায়াতের খরচ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। বাংলাদেশ ও ভারত থেকে আসা পর্যটকদের জন্য সঠিক পরিকল্পনা এবং কিছু স্মার্ট বুকিং টিপস অনুসরণ করলে যাতায়াতের খরচ কমানো সম্ভব। এখানে টিকিট বুকিং থেকে শুরু করে অন্যান্য যাতায়াত সংক্রান্ত খরচের পরিকল্পনা তুলে ধরা হলো।
১. বিমান টিকিট বুকিং
অস্ট্রিয়ায় ভ্রমণের প্রথম ধাপ হলো বিমানের টিকিট বুকিং। সাধারণত বাংলাদেশ ও ভারত থেকে অস্ট্রিয়ায় সরাসরি ফ্লাইট পাওয়া যায় না, তাই বেশিরভাগ ভ্রমণকারীদের এক বা একাধিক ট্রানজিট সহ ফ্লাইট নিতে হয়।
- বুকিংয়ের সময়:
- বিমানের টিকিট বুক করার জন্য সর্বোত্তম সময় হলো প্রস্থানের ২-৩ মাস আগে। আগেভাগে বুকিং করলে প্রায়ই সস্তা টিকিট পাওয়া যায়।
- অফ-পিক সিজন, যেমন মার্চ এবং নভেম্বরের দিকে ভ্রমণ করলে খরচ কিছুটা কম হয়।
- ফ্লাইটের পছন্দ:
- কাতার এয়ারওয়েজ, এমিরেটস, তুর্কিশ এয়ারলাইন্স, এবং ইত্তিহাদ এয়ারওয়েজ সাধারণত ট্রানজিটসহ বাংলাদেশ ও ভারত থেকে ভিয়েনা বা সালজবার্গে ভ্রমণকারী অনেক সুবিধা দেয়।
- ভারত থেকে যাদের সরাসরি ফ্লাইট পছন্দ, তাদের জন্য এয়ার ইন্ডিয়া এবং লুফথানসা এয়ারলাইন্স কিছুটা সাশ্রয়ী বিকল্প হতে পারে।
- মূল্য নির্ধারণ:
- সাধারণত ঢাকা থেকে অস্ট্রিয়া রাউন্ডট্রিপ টিকিটের খরচ ৭০,০০০-৯০,০০০ টাকা পর্যন্ত হয়, যা ভ্রমণ সময় এবং এয়ারলাইন্সের উপর নির্ভর করে।
- ভারতের বড় শহর থেকে টিকিটের খরচ প্রায় ৩৫,০০০-৫০,০০০ রুপি পর্যন্ত হতে পারে।
২. অস্ট্রিয়ার অভ্যন্তরীণ পরিবহন ব্যবস্থা
অস্ট্রিয়ায় একবার পৌঁছে গেলে সেখানে স্থানীয় পরিবহনের জন্য বেশ কিছু সাশ্রয়ী এবং সুবিধাজনক অপশন রয়েছে।
- রেল ব্যবস্থা:
- অস্ট্রিয়ার রেল ব্যবস্থা ইউরোপের অন্যতম উন্নত এবং নির্ভরযোগ্য রেল নেটওয়ার্ক। শহর থেকে শহরে সহজেই ট্রেনে যাতায়াত করা যায়। ÖBB (Austrian Federal Railways) এবং ওয়েস্টবান এই অঞ্চলের প্রধান দুটি রেল কোম্পানি।
- ভিয়েনা থেকে সালজবার্গ বা ইন্সব্রুক পর্যন্ত রেল ভ্রমণের খরচ প্রায় ২৫-৫০ ইউরো, যা আসন ও ক্লাসের উপর নির্ভর করে। আগেভাগে বুকিং করলে ডিসকাউন্ট পাওয়া যায়।
- বাস পরিষেবা:
- FlixBus ও Eurolines অস্ট্রিয়ার বিভিন্ন শহরের মধ্যে সাশ্রয়ী মূল্যের বাস পরিষেবা প্রদান করে। ভিয়েনা থেকে সালজবার্গ বা ইনসব্রুক যেতে বাসের ভাড়া প্রায় ১৫-৩০ ইউরো। এটি একটি কম খরচের বিকল্প।
- সিটি ট্রান্সপোর্ট পাস:
- শহরের মধ্যে ঘোরার জন্য ভিয়েনা বা সালজবার্গের জন্য এক বা তিন দিনের ট্রান্সপোর্ট পাস পাওয়া যায়, যা ট্রাম, বাস, এবং সাবওয়ে সেবা দিয়ে থাকে। একটি এক দিনের পাসের খরচ সাধারণত ৮-১০ ইউরো এবং তিন দিনের পাস ১৭-২০ ইউরো পর্যন্ত হয়।
৩. সাশ্রয়ী বুকিং টিপস
- ভ্রমণ এজেন্সির মাধ্যমে বুকিং:
- অনেক ভ্রমণ এজেন্সি বাংলাদেশ ও ভারতে অস্ট্রিয়া সহ শেঙ্গেন ভিসা প্রক্রিয়া এবং পুরো ভ্রমণ প্যাকেজের জন্য সাশ্রয়ী অফার প্রদান করে।
- বুকিং ওয়েবসাইট এবং অ্যাপস:
- Skyscanner, Kayak, এবং Google Flights-এর মতো ওয়েবসাইটে তুলনামূলক কম মূল্যে ফ্লাইট খুঁজে পাওয়া যায়।
- Hostelworld এবং Booking.com সাশ্রয়ী আবাসনের জন্য অনেক বিকল্প প্রদান করে।
৪. যাতায়াতের মোট খরচের আনুমানিক বাজেট
একটি দুই সপ্তাহের অস্ট্রিয়া ভ্রমণের জন্য (বিমান ভাড়া, অভ্যন্তরীণ পরিবহন, এবং সিটি ট্রান্সপোর্টসহ) প্রায় এইভাবে বাজেট পরিকল্পনা করতে পারেন:
- বিমান ভাড়া: বাংলাদেশ থেকে ৮০,০০০ টাকা; ভারত থেকে ৪০,০০০ রুপি (প্রায়)
- অভ্যন্তরীণ পরিবহন: রেল এবং বাস মিলিয়ে মোট প্রায় ১৫০-২০০ ইউরো
- স্থানীয় ট্রান্সপোর্ট পাস: প্রতিদিন প্রায় ১০ ইউরো; ১৪ দিনে মোট ১৪০ ইউরো
অর্থাৎ, মোট যাতায়াতের জন্য প্রায় ২,০০০-২,৫০০ ইউরো বাজেট রাখলে ভালো হয়। স্মার্ট বুকিং এবং ভালো পরিকল্পনা করে পুরো যাতায়াত খরচকে সাশ্রয়ী করা সম্ভব।
অস্ট্রিয়ার প্রধান পর্যটন আকর্ষণসমূহ
১. ভিয়েনা: সংস্কৃতির রাজধানী
ভিয়েনা শুধু অস্ট্রিয়ার রাজধানীই নয়, এটি শিল্প এবং সংগীতের রাজধানী হিসেবেও পরিচিত। এখানে সংগীতশিল্পী মোজার্ট, বিথোভেন এবং শুবার্টের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলির পাশাপাশি চমৎকার স্থাপত্য, মিউজিয়াম, এবং চিত্রকলা গ্যালারি রয়েছে। এখানে আসলে প্রথমেই যে জায়গাগুলি দেখতে চাই তা হলো হফবার্গ প্যালেস এবং শোএনব্রুন প্যালেস।
- হফবার্গ প্যালেস
১৩শ শতাব্দীতে নির্মিত এই রাজপ্রাসাদটি বর্তমানে অস্ট্রিয়ার রাষ্ট্রপতির সরকারি বাসভবন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই প্যালেসে রয়েছে অসাধারণ শৈল্পিক নিদর্শন এবং রাজকীয় সংগ্রহ। এছাড়াও, সিসি মিউজিয়াম, ইম্পেরিয়াল অ্যাপার্টমেন্টস এবং দ্য সিলভার কালেকশন ঘুরে দেখা যায়। এখানে ঢোকার টিকেট সংগ্রহ করতে কিছুটা সময় লাগতে পারে, তাই আগে থেকে টিকেট সংগ্রহ করলে সুবিধা হয়। - ভিয়েনা অপেরা হাউস
ভিয়েনার প্রধান আকর্ষণগুলোর মধ্যে অপেরা হাউস অন্যতম। এটি এক অসাধারণ স্থাপত্য এবং সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে জনপ্রিয়। সংগীতানুষ্ঠান, অপেরা ও ব্যালে শো এখানকার বিশেষ আকর্ষণ। এখানকার টিকেট পেতে আগে থেকেই বুকিং করতে হবে।
২. সালজবার্গ: মোজার্টের শহর
মোজার্টের জন্মস্থান সালজবার্গ তার শৈল্পিক আবহাওয়া ও ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীত পরিবেশের জন্য বিখ্যাত। সালজবার্গে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য স্থান আছে, যেমন হোহেন সালজবার্গ দুর্গ, মোজার্টের জন্মভূমি, এবং মিরাবেল গার্ডেন।
- হোহেন সালজবার্গ দুর্গ
সালজবার্গের প্রাচীন দুর্গগুলির মধ্যে হোহেন সালজবার্গ অন্যতম, যা শহরের উপরে অবস্থিত। দুর্গের উপরে উঠে গেলে পুরো শহর এবং আশপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করা যায়। দুর্গের ইতিহাস জানার জন্য গাইডেড ট্যুরও আছে। - মিরাবেল গার্ডেন
মিরাবেল প্যালেসের আশপাশে এই বাগানটি অবস্থিত, যা ফুলের সৌন্দর্য এবং সুরম্য পরিবেশের জন্য বিখ্যাত। সাউন্ড অফ মিউজিক চলচ্চিত্রের জন্য এই জায়গাটি বিখ্যাত।
৩. ইন্সব্রুক: আল্পসের সৌন্দর্য উপভোগের স্থান
ইন্সব্রুককে বলা হয় আল্পস পর্বতমালার কেন্দ্র। যারা স্কিইং করতে পছন্দ করেন, তাদের জন্য এটি উপযুক্ত জায়গা।
- গোল্ডেন রুফ
ইন্সব্রুকের অন্যতম দর্শনীয় স্থান হলো গোল্ডেন রুফ। এটি একটি ঐতিহাসিক ভবন, যার সোনার মতো উজ্জ্বল ছাদ পর্যটকদের আকর্ষণ করে। - নর্ডকেট ক্যাবল কার
নর্ডকেট ক্যাবল কারটি ভ্রমণকারীদের সরাসরি আল্পসের উপর নিয়ে যায়। এখানে আলপাইন ভিউ এবং পর্বতমালা দেখতে অসাধারণ লাগে।
খাবার ও পানীয়
অস্ট্রিয়ার খাবার এর নিজস্ব স্বাদ ও ঐতিহ্যকে ধারণ করে। ভিয়েনিজ স্নিটজেল, অ্যাপেল স্ট্রুডেল এবং স্যাকার টর্টে এর অন্যতম জনপ্রিয় খাবার।
- ভিয়েনিজ স্নিটজেল: এই খাবারটি অস্ট্রিয়ার ঐতিহ্যবাহী মাংসের পদ, যা মাংসের কুচি নিয়ে তৈরি এবং এটি সোনালি খোসায় ঢাকা থাকে।
- স্যাকার টর্ট: এটি একটি চকোলেট কেক, যা ভিয়েনার স্পেশালিটি এবং অস্ট্রিয়ার ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্ন হিসেবে খ্যাত।
- অ্যাপেল স্ট্রুডেল: এটি একটি অস্ট্রিয়ান ডেজার্ট, যা আপেলের পূর্ণ এবং মজাদার সুগন্ধ নিয়ে তৈরি।
অস্ট্রিয়ায় নিরাপত্তা এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
অস্ট্রিয়া অত্যন্ত নিরাপদ একটি দেশ। তবে ভ্রমণের সময় আপনাকে ব্যক্তিগত সুরক্ষার প্রতি মনোযোগী হতে হবে। পাবলিক ট্রান্সপোর্টও নিরাপদ এবং সহজে পাওয়া যায়।
কিছু দরকারি টিপস
- পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার: অস্ট্রিয়াতে ট্রাম, বাস, এবং সাবওয়ে সহজলভ্য। টিকিট আগে থেকেই সংগ্রহ করলে সুবিধা হয়।
- ভাষা: বেশিরভাগ মানুষ ইংরেজি জানে, কিন্তু জার্মান ভাষার কিছু সাধারণ বাক্য শিখে রাখা ভালো।
- জলবায়ু অনুযায়ী পোশাক: ভ্রমণের সময় মাস অনুযায়ী পোশাক নেওয়া উচিত।
অস্ট্রিয়া ভ্রমণকারীদের জন্য একটি সেরা গন্তব্য, যেখানে প্রকৃতির অপরূপ দৃশ্য এবং ঐতিহাসিক স্থাপত্যের অপূর্ব সংমিশ্রণ পাওয়া যায়। আমি এই ভ্রমণে অনেক কিছু শিখেছি এবং অসংখ্য সুন্দর স্মৃতি নিয়ে দেশে ফিরে এসেছি। আশা করছি, এই ভ্রমণ গাইড বাংলাদেশ ও ভারত থেকে আগত পর্যটকদের জন্য সহায়ক হবে।