saffron

কেশরের স্বাস্থ্য উপকারিতা

কেশর, যা “সোনালি মশলা” নামে পরিচিত, এটি পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান ও জনপ্রিয় মশলাগুলোর একটি। এর বৈজ্ঞানিক নাম Crocus sativus এবং এর উৎপত্তি মূলত মধ্যপ্রাচ্যে হলেও এখন ভারত, ইরান, স্পেনসহ বিভিন্ন দেশে এটি ব্যাপকভাবে চাষ হয়। কেশরের এক ধরণের মিষ্টি সুবাস ও উজ্জ্বল রং রয়েছে, যা রান্নার স্বাদ ও রং বৃদ্ধিতে ব্যবহৃত হয়। শুধু রান্নাতেই নয়, কেশরের রয়েছে অসাধারণ স্বাস্থ্য উপকারিতা।

সতর্কবার্তা: এই প্রবন্ধটি শুধুমাত্র সাধারণ তথ্য ও শিক্ষামূলক উদ্দেশ্যে লেখা হয়েছে। ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য বা চিকিৎসা সংক্রান্ত যেকোনো প্রশ্নের জন্য অবশ্যই একজন যোগ্য চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

১. কেশর কী?

কেশর, যা সাধারণত রান্নায় ব্যবহৃত হয়, এটি মূলত Crocus sativus ফুলের স্টিগমা বা ফুলের মধ্যবর্তী লাল অংশ থেকে সংগ্রহ করা হয়। একটি ফুল থেকে মাত্র তিনটি স্টিগমা পাওয়া যায়, যা এই মশলাকে অত্যন্ত দুর্লভ এবং মূল্যবান করে তোলে।

প্রাচীন কাল থেকেই কেশর ঔষধি এবং খাবারের রং বাড়ানোর উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এতে একাধিক প্রাকৃতিক উপাদান থাকে যা শরীর ও মনের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

২. কেশরের পুষ্টিগুণ

কেশর পুষ্টিতে ভরপুর এবং এতে রয়েছে প্রচুর ভিটামিন, খনিজ পদার্থ ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা শরীরের বিভিন্ন কার্যক্রমকে সহায়তা করে। এতে নিম্নলিখিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপাদান রয়েছে:

  • ক্যারোটিনোয়েডস: কেশরে ক্রোসিন এবং ক্রোসেটিন নামক দুটি গুরুত্বপূর্ণ ক্যারোটিনোয়েড থাকে, যা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে এবং শরীরের কোষগুলোকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে।
  • ভিটামিন সি: ভিটামিন সি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।
  • ম্যাঙ্গানিজ: ম্যাঙ্গানিজ হাড়ের স্বাস্থ্য উন্নত করতে এবং শরীরে শক্তির সঞ্চালন বাড়াতে সহায়ক।
  • ফ্ল্যাভোনয়েডস: এতে থাকা ফ্ল্যাভোনয়েডস ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করতে পারে।
  • অ্যান্টিঅক্সিডেন্টস: অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের উচ্চ মাত্রা শরীরের কোষগুলিকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে এবং বার্ধক্য বিলম্বিত করে।

৩. কেশরের স্বাস্থ্য উপকারিতা

কেশরের বিভিন্ন স্বাস্থ্য উপকারিতা রয়েছে। নিম্নলিখিত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য উপকারিতা নিয়ে আলোচনা করা হলো:

৩.১ মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়ন

কেশর মানসিক চাপ কমাতে এবং মনের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। এতে থাকা ক্রোসিন এবং সাফ্রানাল নামক উপাদান মানসিক চাপ, উদ্বেগ ও বিষণ্ণতা কমাতে সহায়ক। কেশর ব্যবহারে সেরোটোনিনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়, যা মনের প্রশান্তি ও উজ্জীবনে সহায়ক।

গবেষণালব্ধ প্রমাণ

একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা কেশর নিয়মিতভাবে গ্রহণ করেন তাদের মধ্যে উদ্বেগ এবং বিষণ্ণতার মাত্রা কম থাকে। কেশরের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও নিউরোপ্রোটেক্টিভ বৈশিষ্ট্যগুলি স্নায়ুর কার্যক্রমকে উন্নত করতে সহায়ক।

৩.২ হৃদরোগের জন্য উপকারী

কেশর হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। এতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদানগুলি রক্তনালীকে সচল রাখে এবং হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি হ্রাস করে। ক্রোসেটিন নামক উপাদান রক্ত সঞ্চালন বাড়ায় এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।

৩.৩ ত্বকের স্বাস্থ্য রক্ষা

কেশর ত্বকের সৌন্দর্য এবং স্বাস্থ্য বৃদ্ধিতে খুবই কার্যকর। এতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান ত্বককে উজ্জ্বল করতে এবং ত্বকের বার্ধক্য রোধ করতে সহায়ক। নিয়মিত কেশর ব্যবহারে ত্বকের মৃত কোষ দূর হয় এবং ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পায়।

৩.৪ হজম প্রক্রিয়ায় সহায়ক

কেশর হজম প্রক্রিয়াকে সুস্থ রাখে। এতে থাকা প্রাকৃতিক উপাদান গ্যাস্ট্রিক সমস্যা, পেট ফাঁপা এবং বদহজমের সমস্যা কমাতে সাহায্য করে। এছাড়া এটি অন্ত্রের প্রদাহ কমিয়ে হজমে সহায়ক।

৩.৫ ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়ক

কেশর ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে, কারণ এটি ক্ষুধা দমন করে এবং অতিরিক্ত খাওয়ার প্রবণতা কমায়। গবেষণায় দেখা গেছে, কেশর গ্রহণ করলে খাওয়ার পরিমাণ কমে যায় এবং শরীরে ফ্যাট জমার প্রবণতা হ্রাস পায়।

৩.৬ হাড়ের স্বাস্থ্য রক্ষা

কেশরে থাকা ম্যাঙ্গানিজ এবং ক্যালসিয়াম হাড়ের ঘনত্ব বজায় রাখতে সহায়ক। এটি হাড়কে শক্তিশালী করে এবং অস্টিওপরোসিসের মতো হাড়ের সমস্যার ঝুঁকি কমায়।

৪. কেশর ব্যবহারের সঠিক পদ্ধতি

কেশর থেকে সর্বাধিক উপকার পেতে এর সঠিক পদ্ধতিতে ব্যবহার করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রান্নার স্বাদ ও গুণগত মান বৃদ্ধির পাশাপাশি এটি স্বাস্থ্য উপকারিতা প্রদানেও সহায়ক। কেশর ব্যবহারের কিছু জনপ্রিয় এবং কার্যকর পদ্ধতি নিচে আলোচনা করা হলো:

৪.১ গরম পানিতে কেশর ভিজিয়ে রাখা

কেশরের স্টিগমা বা সুতোকে গরম পানিতে ১৫-২০ মিনিট ভিজিয়ে রাখা সবচেয়ে সহজ এবং কার্যকর পদ্ধতিগুলোর একটি। ভিজানোর ফলে কেশরের রং এবং উপকারিতাগুলি পানিতে মিশে যায়, যা পান করলে সহজে শরীরে শোষিত হয়। এই পানি সরাসরি পান করতে পারেন, অথবা এটি রান্নায় ব্যবহার করা যেতে পারে।

৪.২ দুধে কেশর মিশিয়ে পান করা

দুধের সাথে কেশর মিশিয়ে পান করা একটি স্বাস্থ্যকর এবং প্রচলিত পদ্ধতি। এর জন্য ২-৩টি কেশরের সুতো এক গ্লাস গরম দুধে মিশিয়ে ৫-১০ মিনিট অপেক্ষা করতে হয়। এই মিশ্রণটি সুষম পুষ্টি সরবরাহ করে, যা স্নায়ু শিথিল করতে এবং মানসিক প্রশান্তি আনতে সহায়ক। রাতে ঘুমের আগে এটি পান করলে ঘুমের গুণগত মান উন্নত হতে পারে।

৪.৩ রান্নায় কেশর ব্যবহার

রান্নার সময় কেশর ব্যবহার করলে খাবারের স্বাদ, রং এবং পুষ্টিমূল্য বৃদ্ধি পায়। বিশেষত পোলাও, বিরিয়ানি, মিষ্টান্ন এবং সুপে কেশর মেশানো হয়। রান্নার আগে কেশর কিছুক্ষণ গরম পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে এবং তারপর এই কেশর মিশ্রিত পানি রান্নায় যোগ করতে হবে।

৪.৪ ত্বকে কেশর প্রয়োগ

ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্যকর দেখানোর জন্য কেশরের পেস্ট তৈরি করে ত্বকে প্রয়োগ করা হয়। এক চিমটি কেশর এক চামচ দুধে মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করে ত্বকে লাগান এবং ১৫-২০ মিনিট রেখে দিন। নিয়মিত ব্যবহারে ত্বক উজ্জ্বল, মসৃণ ও ব্রণহীন হতে পারে।

৪.৫ চা বা হার্বাল টিতে কেশর

চা বা হার্বাল টিতে কেশর মিশিয়ে পান করা খুবই জনপ্রিয় এবং স্বাস্থ্যকর অভ্যাস। এটি শরীরকে উষ্ণ রাখে, হজমে সহায়ক এবং মানসিক প্রশান্তি আনে। এক কাপ চায়ের মধ্যে ২-৩টি কেশরের সুতো মিশিয়ে ৫-১০ মিনিট রেখে দিয়ে পান করতে পারেন।

৪.৬ মধু ও কেশরের মিশ্রণ

মধু এবং কেশরের মিশ্রণ পুষ্টি ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের দারুণ উৎস। ২-৩টি কেশরের সুতো এক চামচ মধুতে মিশিয়ে খেলে এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে এবং শ্বাসনালীর সমস্যায় সহায়ক হতে পারে।

৫. কেশরের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও সতর্কতা

যদিও কেশর অনেক উপকারী, তবে এর কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও সতর্কতা মেনে চলা উচিত:

৫.১ অতিরিক্ত সেবনে সমস্যা

অতিরিক্ত কেশর সেবনে মাথাব্যথা, ঘুমের সমস্যা, এবং রক্তচাপ কমে যাওয়ার মতো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। দিনে ২-৩ স্টিগমার বেশি কেশর ব্যবহার না করাই উত্তম।

৫.২ গর্ভবতী মহিলাদের জন্য সতর্কতা

গর্ভবতী মহিলাদের কেশর ব্যবহারে সতর্ক থাকা উচিত, কারণ অতিরিক্ত কেশর সেবন গর্ভপাতের সম্ভাবনা বাড়াতে পারে। গর্ভাবস্থায় কেশর ব্যবহারের পূর্বে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

৫.৩ কিডনির সমস্যা

কেশরের কিছু উপাদান কিডনির ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে, তাই কিডনির সমস্যায় ভোগা ব্যক্তিদের কেশর সেবনে সতর্ক থাকা উচিত।

কেশর একটি দুর্লভ এবং মূল্যবান মশলা, যা প্রাকৃতিক উপাদানে ভরপুর এবং স্বাস্থ্য উপকারিতায় অতুলনীয়।

Check Also

পুরুষদের জন্য আঞ্জির (Fig) খাওয়ার স্বাস্থ্য উপকারিতা

আঞ্জির (Fig), যা বৈজ্ঞানিকভাবে Ficus carica নামে পরিচিত, একটি প্রাচীন এবং পুষ্টিকর ফল। আঞ্জির খাওয়া …

ডিমের কুসুম খাওয়ার স্বাস্থ্য উপকারিতা

ডিম মানব শরীরের জন্য একটি চমৎকার পুষ্টির উৎস, এবং তার মধ্যে ডিমের কুসুম বিশেষ গুরুত্ব …

Exit mobile version