প্লাম বা বরই (বিভিন্ন জায়গায় এটিকে বরই নামেও ডাকা হয়) বিশ্বের অনেক দেশে পরিচিত একটি সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর ফল। এটি শুধুমাত্র এর মিষ্টি-টক স্বাদের জন্য নয়, বরং এর স্বাস্থ্য উপকারিতার জন্যও বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। প্লাম ফল বিভিন্ন রঙ ও আকারে পাওয়া যায় এবং এতে রয়েছে প্রচুর ভিটামিন, খনিজ, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং অন্যান্য পুষ্টি উপাদান।
প্লাম ফলের পরিচিতি
প্লাম হলো এক ধরণের ড্রুপ ফল, অর্থাৎ এটি এমন একটি ফল যার ভেতরে একটি শক্ত বিচি থাকে। এটি Prunus গণের অন্তর্ভুক্ত এবং এটি মূলত এশিয়া, ইউরোপ এবং আমেরিকায় ব্যাপকভাবে জন্মায়। প্লামের কয়েকটি প্রজাতি হল:
- ইউরোপীয় প্লাম (Prunus domestica)
- জাপানি প্লাম (Prunus salicina)
- ড্যামসন প্লাম (Prunus insititia)
এর রং লাল, বেগুনি, হলুদ বা সবুজ হতে পারে এবং প্রতিটি প্রজাতির স্বাদ ও গঠন ভিন্ন।
প্লাম ফলের পুষ্টিগুণ
প্লাম ফল স্বল্প ক্যালোরিযুক্ত কিন্তু পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ। প্রতি ১০০ গ্রাম প্লামে যা থাকে:
- ক্যালোরি: ৪৬
- কার্বোহাইড্রেট: ১১ গ্রাম
- ফাইবার: ১.৪ গ্রাম
- প্রোটিন: ০.৭ গ্রাম
- ভিটামিন সি: দৈনিক প্রয়োজনের ১৫%
- ভিটামিন এ: দৈনিক প্রয়োজনের ৫%
- পটাশিয়াম: ১৫৭ মিলিগ্রাম
- অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট: পলিফেনলস, ক্যারোটিনয়েডস (Carotenoid)
প্লাম ফলের স্বাস্থ্য উপকারিতা
১. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি
প্লামে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি, যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। এটি ঠাণ্ডা, সর্দি এবং অন্যান্য সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে।
২. হজমশক্তি উন্নত করে
প্লামে থাকা ডায়েটারি ফাইবার হজম প্রক্রিয়া সহজ করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে। এটি অন্ত্রের স্বাস্থ্য উন্নত করে।
৩. হৃদরোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে
প্লামে পটাশিয়াম রয়েছে, যা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং হৃদপিণ্ডের কার্যকারিতা উন্নত করতে সাহায্য করে।
৪. ত্বকের জন্য উপকারী
প্লামের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ত্বকের বয়সের ছাপ কমাতে এবং ত্বককে উজ্জ্বল রাখতে সাহায্য করে। এটি বলিরেখা কমায় এবং ত্বককে মসৃণ রাখে।
৫. অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ
প্লামে পলিফেনল নামক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে, যা শরীর থেকে ফ্রি র্যাডিকেল দূর করে। এটি ক্যান্সার প্রতিরোধে এবং বয়সের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন রোগ কমাতে সাহায্য করে।
৬. হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী
প্লামে রয়েছে ভিটামিন কে এবং ম্যাঙ্গানিজ, যা হাড়ের ঘনত্ব বজায় রাখতে সাহায্য করে। এটি অস্টিওপোরোসিস প্রতিরোধে কার্যকর।
৭. ওজন কমাতে সহায়ক
প্লামের ক্যালোরি কম এবং ফাইবার বেশি থাকায় এটি ক্ষুধা কমাতে সাহায্য করে। এটি মেটাবলিজম বৃদ্ধি করতেও সহায়ক।
৮. ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে
প্লামের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম, যা রক্তের সুগার নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। এছাড়াও, এটি ইনসুলিনের কার্যকারিতা বাড়ায়।
৯. মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী
প্লামের মধ্যে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং ভিটামিন স্নায়ুতন্ত্রকে সুরক্ষিত রাখে। এটি মানসিক চাপ কমায় এবং স্মৃতিশক্তি উন্নত করে।
১০. লিভারের কার্যকারিতা উন্নত করে
প্লামে ডিটক্সিফাইং বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা লিভারকে সুস্থ রাখতে এবং বিষাক্ত পদার্থ দূর করতে সাহায্য করে।
প্লাম ফলের ব্যবহার
১. কাঁচা ফল হিসেবে
প্লাম কাঁচা খাওয়ার জন্য আদর্শ। এটি স্বাদে মিষ্টি এবং পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ।
২. জুস বা স্মুদি তৈরিতে
প্লাম ফল দিয়ে তৈরি জুস বা স্মুদি অত্যন্ত সুস্বাদু এবং স্বাস্থ্যকর।
৩. সালাদে সংযোজন
প্লামের টুকরা সালাদে যোগ করলে এটি স্বাদ এবং পুষ্টি বৃদ্ধি করে।
৪. প্লাম জ্যাম এবং জেলি
প্লামের জ্যাম বা জেলি ব্রেকফাস্টে টোস্টের সঙ্গে খাওয়ার জন্য আদর্শ।
৫. শুকনো প্লাম (প্রুন)
শুকনো প্লাম বা প্রুন হলো একটি পুষ্টিকর স্ন্যাকস, যা কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে।
প্লাম ফলের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
যদিও প্লাম অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর, তবে কিছু সতর্কতা মেনে চলা উচিত:
- অতিরিক্ত প্লাম খেলে ডায়রিয়া হতে পারে।
- ডায়াবেটিক রোগীদের সীমিত পরিমাণে খাওয়া উচিত, কারণ এতে প্রাকৃতিক চিনি থাকে।
- যাদের প্লামের প্রতি অ্যালার্জি রয়েছে, তাদের এটি এড়িয়ে চলা উচিত।
প্লামের স্বাস্থ্য উপকারিতা নিয়ে গবেষণা
প্লামের উপকারিতা নিয়ে অনেক বৈজ্ঞানিক গবেষণা হয়েছে। কিছু উল্লেখযোগ্য গবেষণা:
- ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে প্লাম: একটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্লামে থাকা পলিফেনল রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে।
- অস্টিওপোরোসিস প্রতিরোধে প্লাম: ২০১১ সালে একটি গবেষণায় দেখা যায়, প্রুন হাড়ের ঘনত্ব বাড়াতে সাহায্য করে।
- অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট প্রভাব: প্লামের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ফ্রি র্যাডিকেল দূর করে ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে।
প্লাম ফল কেন খাবেন?
প্লাম একটি সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর ফল, যা বিভিন্নভাবে আমাদের শরীরকে সুস্থ রাখে। এটি কাঁচা, জুস, জ্যাম বা প্রুন হিসেবে সহজেই গ্রহণ করা যায়। এর স্বাদ এবং পুষ্টিগুণ উভয়ই এটি আমাদের খাদ্যতালিকায় যোগ করার জন্য যথেষ্ট।
প্লাম ফল একটি প্রাকৃতিক উপহার, যা শরীরকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। এটি শুধুমাত্র পুষ্টিকর নয়, বরং বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধেও কার্যকর। তবে, সঠিক পরিমাণে এবং নিয়ম মেনে খাওয়া উচিত।