শরীরের ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বাড়লে তা গাউট, কিডনি স্টোন, এবং অন্যান্য গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। ইউরিক অ্যাসিড হল একটি বর্জ্য পদার্থ যা শরীরের purine নামে এক ধরনের যৌগের বিপাকের ফলস্বরূপ উৎপন্ন হয়। সাধারণভাবে এটি রক্তের মাধ্যমে শরীর থেকে ফিল্টার হয়ে কিডনির মাধ্যমে মূত্রের মাধ্যমে বের হয়ে যায়। তবে যখন ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বেড়ে যায়, তখন এটি শরীরের বিভিন্ন অংশে সঞ্চিত হতে পারে, বিশেষ করে সং joints, কিডনি এবং অন্যান্য টিস্যুতে, যা নানা ধরনের শারীরিক সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।
এখনকার দিনে, বহু মানুষ ইউরিক অ্যাসিডের উচ্চ মাত্রার কারণে বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছেন। অনেকেই এটি কমানোর জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নেন, তবে কিছু প্রাকৃতিক বা ঘরোয়া উপায়ও রয়েছে যা ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা কমাতে সাহায্য করতে পারে।
১. ইউরিক অ্যাসিড কি?
যতটা সম্ভব সহজভাবে বললে, ইউরিক অ্যাসিড হল এক ধরনের বর্জ্য পদার্থ যা শরীরে পুরাইন নামক যৌগের বিপাকের ফলে তৈরি হয়। পুরাইন আমাদের খাদ্যে থাকে, বিশেষত মাংস, শিম, শাকসবজি, এবং অন্যান্য খাদ্য দ্রব্যে। যখন শরীর এই পুরাইনকে প্রক্রিয়া করে, তখন ইউরিক অ্যাসিড উৎপন্ন হয়।
সাধারণভাবে, ইউরিক অ্যাসিড রক্তে মিশে কিডনি দ্বারা ফিল্টার হয়ে মূত্রের মাধ্যমে শরীর থেকে বের হয়ে যায়। কিন্তু যখন এটি শরীরে অতিরিক্ত পরিমাণে সঞ্চিত হয়, তখন এটি গাউট, কিডনি স্টোন, এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।
২. ইউরিক অ্যাসিডের উচ্চ মাত্রার কারণ
শরীরে ইউরিক অ্যাসিডের উচ্চ মাত্রার কিছু সাধারণ কারণ হলো:
- খাদ্যাভ্যাস: বেশি পরিমাণে মাংস, শখ, সামুদ্রিক মাছ, এবং বিশেষ কিছু শাকসবজি খাওয়া।
- ওজন বৃদ্ধি: অতিরিক্ত ওজন ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করতে পারে।
- কিডনি সমস্যাগুলি: কিডনি যদি সঠিকভাবে ইউরিক অ্যাসিড ফিল্টার না করতে পারে তবে এটি শরীরে সঞ্চিত হতে পারে।
- আলকোহল: বিশেষত বীয়ার এবং মদ জাতীয় পানীয় ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বাড়াতে সহায়ক।
- পথ্য চিকিৎসা: কিছু ওষুধ যেমন ডায়িউরেটিক্স ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বাড়াতে পারে।
৩. ইউরিক অ্যাসিড কমানোর ঘরোয়া উপায়
৩.১. জলপান
প্রথমেই একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করা। পানি শরীর থেকে ইউরিক অ্যাসিড বের করতে সাহায্য করে। একে “ডিটক্সিফিকেশন” বলা হয়, যেখানে শরীরের বর্জ্য পদার্থগুলি শরীর থেকে বের হয়ে যায়। প্রতিদিন কমপক্ষে ৮-১০ গ্লাস পানি পান করা উচিত।
- প্রতিদিনের পানি পরিমাণ: আপনি যদি দিনে ৮-১০ গ্লাস পানি পান করতে পারেন, তা হলে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা কমাতে সাহায্য করবে।
- গরম পানি: গরম পানি বা হালকা গরম জল খাওয়া ইউরিক অ্যাসিডের জন্য আরও উপকারী হতে পারে। এটি হজম প্রক্রিয়া উন্নত করে এবং ইউরিক অ্যাসিড বের করতে সাহায্য করে।
৩.২. ভিটামিন সি
ভিটামিন সি একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা শরীরের ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা কমাতে সাহায্য করতে পারে। এটি শরীরে ইউরিক অ্যাসিডের ক্ষয়প্রক্রিয়া শুরু করতে সাহায্য করে, এবং ইউরিক অ্যাসিডের পরিমাণ কমাতে সহায়ক হতে পারে।
- ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার: লেবু, কমলা, আমলকী, স্ট্রবেরি, এবং শিমলালংকাসহ ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া আপনার জন্য উপকারী হতে পারে।
৩.৩. আমলকী (Amla)
আমলকী খুবই কার্যকরী একটি উপাদান, যা ইউরিক অ্যাসিড কমানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি শরীরের প্রাকৃতিক ডিটক্সিফাইয়ার হিসাবে কাজ করে। এটি ইউরিক অ্যাসিডের উচ্চ মাত্রাকে স্বাভাবিক করে।
- আমলকী খাওয়ার পদ্ধতি: আপনি প্রতিদিন এক টুকরো আমলকী খেতে পারেন অথবা আমলকীর রস পান করতে পারেন। এছাড়াও, আমলকী চূর্ণও খাবারের সাথে মিশিয়ে খাওয়া যেতে পারে।
৩.৪. ভিনেগার
অ্যাপল সিডার ভিনেগার শরীরের পিএইচ লেভেল ব্যালান্স করতে সাহায্য করে এবং ইউরিক অ্যাসিড কমাতে সহায়ক। এটি ডিটক্সিফিকেশন প্রক্রিয়া শুরু করতে সাহায্য করে।
- ব্যবহারের পদ্ধতি: এক চামচ অ্যাপল সিডার ভিনেগার এক গ্লাস গরম পানিতে মিশিয়ে প্রতিদিন সকালে পান করা যেতে পারে।
৩.৫. আদা
আদা প্রাকৃতিক অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্য দ্বারা পরিচিত। এটি শরীরে ইউরিক অ্যাসিডের সৃষ্টি কমাতে সাহায্য করতে পারে এবং গাউটের লক্ষণগুলিও কমাতে সহায়ক।
- ব্যবহার: আদা চা খাওয়া, বা খোলসসহ এক টুকরো আদা গরম পানিতে সিদ্ধ করে পান করা যেতে পারে।
৩.৬. তরমুজ
তরমুজ একটি খুবই ভালো হাইড্রেটিং ফল এবং এতে প্রচুর পরিমাণে জল থাকে, যা শরীরের ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে।
- ব্যবহার: তরমুজ খাওয়া এবং তরমুজের রস পান করা ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে।
৩.৭. চেরি
চেরি বিশেষভাবে ইউরিক অ্যাসিডের বিরুদ্ধে কাজ করে। এটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে পূর্ণ, যা ইউরিক অ্যাসিডের ক্ষয়প্রক্রিয়া শুরু করতে সাহায্য করে।
- ব্যবহার: প্রতিদিন কিছু চেরি খাওয়া বা চেরির রস পান করা উপকারী হতে পারে।
৩.৮. হলুদ
হলুদ একটি প্রাকৃতিক অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি উপাদান হিসেবে পরিচিত। এটি শরীরের ইউরিক অ্যাসিডের জমা কমাতে সাহায্য করতে পারে এবং শরীরের প্রদাহ কমাতে সহায়ক।
- ব্যবহার: এক চামচ হলুদ গরম পানিতে মিশিয়ে প্রতিদিন পান করা যেতে পারে।
৪. খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন
শরীরে ইউরিক অ্যাসিডের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে কিছু খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৪.১. প্রোটিনের পরিমাণ কমানো
উচ্চ পরিমাণে মাংস এবং সামুদ্রিক খাবার খাওয়া ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই প্রোটিনের পরিমাণ কমানোর চেষ্টা করুন।
৪.২. শাকসবজি ও ফলমূলের পরিমাণ বাড়ানো
শাকসবজি ও ফলমূল ইউরিক অ্যাসিড কমাতে সহায়ক। বিশেষত সবুজ শাক, টমেটো, শসা এবং বেল পেপার খুব উপকারী।
৪.৩. বেশি পরিমাণে পানি পান করা
এটি পুনরায় উল্লেখযোগ্য যে, বেশি পরিমাণে পানি পান করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি শরীর থেকে ইউরিক অ্যাসিড বের করতে সাহায্য করে।
শরীরে ইউরিক অ্যাসিডের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে ঘরোয়া প্রতিকারগুলি কার্যকর হতে পারে, তবে প্রতিটি ব্যক্তির শরীরের অবস্থান আলাদা এবং কিছু নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। এই নিবন্ধে দেওয়া ঘরোয়া প্রতিকারগুলি সাধারণ জ্ঞানের জন্য, তবে যদি আপনি ইউরিক অ্যাসিডের উচ্চ মাত্রা বা গাউটের সমস্যায় ভুগছেন, তাহলে একজন যোগ্য চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।