বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ত্বকের টানটান ভাব কমে যায় এবং দেখা দেয় ঢিলে-ঢালা, ভাঁজ পড়া ত্বকের সমস্যা। এটি কেবল বার্ধক্যের লক্ষণ নয়; অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাত্রা, সঠিক যত্নের অভাব, এবং পরিবেশগত কারণেও এই সমস্যা দেখা দিতে পারে। সঠিক জ্ঞান এবং কিছু ঘরোয়া পদ্ধতির মাধ্যমে এই ত্বকের সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
ঢিলে-ঢালা, ভাঁজ পড়া ত্বক কী?
ত্বকের স্থিতিস্থাপকতা কমে গেলে এবং কোলাজেন ও ইলাস্টিনের মাত্রা হ্রাস পেলে ত্বক ঢিলে হয়ে যায় ও ভাঁজ পড়ে। সাধারণত এটি মুখ, গলা, হাত এবং হাঁটুর আশেপাশে বেশি লক্ষ্য করা যায়।
ঢিলে-ঢালা, ভাঁজ পড়া ত্বকের কারণসমূহ
১. বয়সের প্রভাব:
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ত্বকের কোলাজেন এবং ইলাস্টিন উৎপাদন কমে যায়, ফলে ত্বক তার টানটান ভাব হারায়।
২. সূর্যের UV রশ্মি:
অতিরিক্ত রোদে থাকা ত্বকের কোলাজেন ভেঙে ফেলে এবং ত্বকের স্থিতিস্থাপকতা নষ্ট করে।
৩. ওজন ওঠানামা:
দ্রুত ওজন কমলে বা বাড়লে ত্বক প্রসারিত হয়ে যায় এবং আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসতে না পারায় ঢিলে হয়ে যায়।
৪. শুষ্ক ত্বক:
ত্বকে আর্দ্রতার অভাব হলে এটি দ্রুত পাতলা এবং ভাঁজযুক্ত হয়ে পড়ে।
৫. জেনেটিক ফ্যাক্টর:
পারিবারিক ইতিহাসের কারণে অনেকের ত্বকের স্থিতিস্থাপকতা কম হয়।
ঢিলে-ঢালা ত্বকের ঘরোয়া প্রতিকার
১. অ্যালোভেরা জেল ম্যাসাজ
অ্যালোভেরা ত্বকের জন্য একটি প্রাকৃতিক ময়েশ্চারাইজার এবং এতে রয়েছে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। এটি ত্বকের ইলাস্টিন এবং কোলাজেন উৎপাদন বাড়িয়ে ত্বকের দৃঢ়তা ফিরিয়ে আনে।
পদ্ধতি:
- একটি তাজা অ্যালোভেরা পাতা কেটে ভেতরের জেল বের করে নিন।
- জেলটি ত্বকে লাগিয়ে ১০-১৫ মিনিট ম্যাসাজ করুন।
- ৩০ মিনিট রেখে ঠান্ডা জল দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
- প্রতিদিন এই পদ্ধতি অনুসরণ করুন।
২. ডিমের সাদা অংশের মাস্ক
ডিমের সাদা অংশে প্রোটিন এবং কোলাজেন রয়েছে, যা ত্বককে টানটান করতে সাহায্য করে।
পদ্ধতি:
- একটি ডিমের সাদা অংশ ভালোভাবে ফেটিয়ে নিন।
- এটি মুখ এবং গলার ত্বকে লাগিয়ে ১৫-২০ মিনিট রাখুন।
- শুকিয়ে গেলে ঠান্ডা জল দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
- সপ্তাহে ২-৩ বার ব্যবহার করুন।
৩. নারকেল তেল ম্যাসাজ
নারকেল তেল ত্বকের গভীরে আর্দ্রতা যোগায় এবং ত্বকের ইলাস্টিসিটি বাড়ায়।
পদ্ধতি:
- অল্প গরম নারকেল তেল নিয়ে আক্রান্ত স্থানে ১০-১৫ মিনিট ম্যাসাজ করুন।
- সারা রাত রেখে সকালে ধুয়ে ফেলুন।
- প্রতিদিন রাতে এই পদ্ধতি অনুসরণ করুন।
৪. অলিভ অয়েল (জলপাই তেল)
অলিভ অয়েলে ভিটামিন E এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে, যা ত্বকের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে।
পদ্ধতি:
- কয়েক ফোঁটা অলিভ অয়েল হাতে নিয়ে মুখ, গলা বা অন্য আক্রান্ত স্থানে ম্যাসাজ করুন।
- এটি সারা রাত রেখে দিন।
- প্রতিদিন রাতে এটি ব্যবহার করুন।
৫. শসার রস (শশার রস)
শসার রস ত্বকের টানটান ভাব ফিরিয়ে আনতে সহায়ক এবং এটি ত্বক ঠান্ডা রাখে।
পদ্ধতি:
- একটি শসা কেটে ব্লেন্ড করে রস বের করে নিন।
- শসার রস ত্বকে লাগিয়ে ১৫-২০ মিনিট রাখুন।
- ঠান্ডা জল দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
- প্রতিদিন এটি ব্যবহার করলে ত্বকের দৃঢ়তা বাড়বে।
৬. কলার প্যাক
কলা ত্বকের জন্য একটি ভালো প্রাকৃতিক ময়েশ্চারাইজার এবং এতে রয়েছে ভিটামিন A, B, E এবং পটাশিয়াম।
পদ্ধতি:
- একটি পাকা কলা চটকে ত্বকে লাগান।
- ২০ মিনিট রেখে ঠান্ডা জল দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
- সপ্তাহে ২-৩ বার ব্যবহার করুন।
৭. মধু এবং দইয়ের প্যাক
মধু এবং দই ত্বককে আর্দ্র রাখে এবং প্রাকৃতিকভাবে টানটান করতে সাহায্য করে।
পদ্ধতি:
- ২ টেবিল চামচ দই এবং ১ টেবিল চামচ মধু মিশিয়ে নিন।
- এটি ত্বকে লাগিয়ে ২০ মিনিট রেখে দিন।
- ঠান্ডা জল দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
- সপ্তাহে ২ বার এই পদ্ধতি অনুসরণ করুন।
৮. গ্রিন টি টোনার
গ্রিন টিতে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে, যা ত্বকের বার্ধক্য রোধ করে এবং ত্বকের ইলাস্টিসিটি বাড়ায়।
পদ্ধতি:
- এক কাপ গ্রিন টি তৈরি করে ঠান্ডা করুন।
- তুলার বল ব্যবহার করে এটি ত্বকে লাগান।
- শুকিয়ে গেলে জল দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
- প্রতিদিন সকালে এবং রাতে এটি ব্যবহার করুন।
৯. পেঁপের প্যাক
পেঁপেতে রয়েছে প্যাপেইন এনজাইম, যা মৃত কোষ দূর করে এবং ত্বকের ইলাস্টিসিটি পুনরুদ্ধার করে।
পদ্ধতি:
- পাকা পেঁপে চটকে পেস্ট বানিয়ে নিন।
- এটি মুখে ও গলায় লাগিয়ে ১৫ মিনিট রাখুন।
- ঠান্ডা জল দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
- সপ্তাহে ২ বার ব্যবহার করুন।
১০. পর্যাপ্ত জল পান
ত্বকের আর্দ্রতা এবং ইলাস্টিসিটি বজায় রাখতে দিনে অন্তত ৮-১০ গ্লাস জল পান করুন। জল ত্বকের কোষগুলিকে হাইড্রেটেড রাখে এবং ত্বকের টানটান ভাব ধরে রাখতে সাহায্য করে।
ঢিলে–ঢালা ত্বক প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাদ্য
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ত্বকের স্থিতিস্থাপকতা কমে যায় এবং ত্বক ঢিলে বা ভাঁজযুক্ত হয়ে পড়ে। তবে সঠিক খাদ্যাভ্যাস এবং পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের মাধ্যমে ত্বকের সৌন্দর্য এবং শক্তি বজায় রাখা সম্ভব। বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান ত্বককে সুস্থ, টানটান এবং কোমল রাখতে সাহায্য করে। চলুন দেখি, কী ধরনের পুষ্টিকর খাদ্য ত্বকের স্বাস্থ্য বজায় রাখতে সহায়ক।
১. ভিটামিন C সমৃদ্ধ খাদ্য
ভিটামিন C ত্বকের কোলাজেন উৎপাদন বাড়াতে সহায়ক। কোলাজেন ত্বকের স্থিতিস্থাপকতা এবং টানটান ভাব বজায় রাখে, যা ঢিলে-ঢালা ত্বক প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ।
ভিটামিন C-এর প্রধান উৎস:
- কমলালেবু (Komola Lebu)
- লেবু (Lebu)
- অমলকী (Amloki)
- স্ট্রবেরি (Strawberry)
- ব্রকলি (Broccoli)
- শিমলা মরিচ (Shimla Morich)
ব্যবহার: ভিটামিন C সমৃদ্ধ খাবারগুলি প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করুন, যেমন, স্যালাডে লেবু বা কমলালেবু যোগ করা, ব্রকলি অথবা শিমলা মরিচ রান্না করা।
২. ভিটামিন E সমৃদ্ধ খাদ্য
ভিটামিন E ত্বককে আর্দ্র রাখে এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে, যা ত্বকের বার্ধক্য প্রক্রিয়া ধীর করে।
ভিটামিন E-এর প্রধান উৎস:
- বাদাম (Badam)
- তিল (Til)
- অলিভ অয়েল (Olive Oil)
- আবোকাডো (Avocado)
- হলুদ (Halud)
ব্যবহার: বাদাম বা তিলের বাটার রুটিতে ব্যবহার করুন, অথবা অলিভ অয়েল দিয়ে রান্না করুন।
৩. কোলাজেন উৎপাদন বৃদ্ধিকারী খাবার
কোলাজেন ত্বকের শক্তি এবং স্থিতিস্থাপকতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিছু খাবার ত্বকে কোলাজেন উৎপাদন বাড়াতে সাহায্য করে।
কোলাজেন উৎপাদনকারী খাবার:
- গরুর হাড়ের মাংস (Cow Bone Broth)
- মাছের তেল (Fish Oil)
- সোয়া প্রোডাক্ট (Soy Products)
- ডিম (Dim)
ব্যবহার: গরুর হাড়ের মাংসের স্যুপ খাওয়া, মাছের তেল খাবার বা খাবারে যোগ করা, সোয়া প্রোডাক্ট (যেমন টোফু) বা ডিম নিয়মিত খাদ্যতালিকায় রাখা।
৪. অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাদ্য
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ত্বকের কোষগুলোকে মুক্ত মৌল থেকে রক্ষা করে এবং ত্বকের বার্ধক্য প্রক্রিয়া ধীর করে।
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাদ্য:
- ব্লু বেরি (Blueberry)
- গোলাপী বা পিঙ্ক সিট্রাস (Pink Citrus)
- তুলসি (Tulsi)
- চিয়া বীজ (Chia Seed)
- সবুজ চা (Green Tea)
ব্যবহার: ব্লু বেরি স্ন্যাক হিসাবে খাওয়া বা স্মুদি তৈরি করা, চিয়া বীজ স্যালাডে যোগ করা, এবং সবুজ চা দৈনন্দিন পান করা।
৫. স্বাস্থ্যকর চর্বি
স্বাস্থ্যকর চর্বি ত্বকের আর্দ্রতা বজায় রাখে এবং ত্বকের কোষ গঠনে সহায়ক। এছাড়া, এটি কোলাজেনের উৎপাদন বৃদ্ধিতেও সাহায্য করে।
স্বাস্থ্যকর চর্বির প্রধান উৎস:
- বাদাম (Badam)
- কাঠবাদাম (Cashew)
- পেস্তা বাদাম (Pista Badam)
- অ্যাভোকাডো (Avocado)
- অলিভ অয়েল (Olive Oil)
ব্যবহার: বাদাম, কাঠবাদাম, পেস্তা বাদাম স্ন্যাক হিসেবে খাওয়া, অথবা অ্যাভোকাডো স্যালাডে যোগ করা।
৬. পানি (Water)
পানি ত্বকের আর্দ্রতা বজায় রাখতে সাহায্য করে এবং ত্বককে উজ্জ্বল ও সতেজ রাখে। পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান না করলে ত্বক শুষ্ক এবং ভাঁজযুক্ত হয়ে পড়ে।
ব্যবহার: প্রতিদিন অন্তত ৮-১০ গ্লাস পানি পান করুন। এছাড়া, তাজা ফলের রসও শরীরে জল সরবরাহ করতে সহায়ক।
৭. আঁশ সমৃদ্ধ খাদ্য
আঁশ ত্বকের জন্য উপকারী এবং হজম প্রক্রিয়া উন্নত করে। এটি ত্বকে অতিরিক্ত টক্সিন দূর করতে সাহায্য করে, যা ত্বকের স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।
আঁশ সমৃদ্ধ খাদ্য:
- ওটস (Joi)
- সবজি (Sabji) – যেমন, শসা, গাজর, পালং শাক
- ফল (Phal) – যেমন, আপেল, নাশপাতি, কলা
ব্যবহার: স্ন্যাকস হিসেবে আপেল বা কলা খাওয়া, স্যালাডে শসা বা গাজর যোগ করা।
ঢিলে-ঢালা ত্বক প্রতিরোধে পুষ্টিকর খাদ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ভিটামিন C, E, কোলাজেন উৎপাদনকারী খাবার, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং স্বাস্থ্যকর চর্বি সমৃদ্ধ খাদ্য নিয়মিত গ্রহণ করে ত্বকের স্থিতিস্থাপকতা এবং টানটান ভাব বজায় রাখা সম্ভব। পাশাপাশি, পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করা এবং আঁশযুক্ত খাবার খাওয়া ত্বককে আর্দ্র ও উজ্জ্বল রাখে।