ছয় সপ্তাহব্যাপী নির্বাচনের পর ভারতের 64 কোটি ভোট গণনা করা হয়েছে, ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) তাদের জাতীয় গণতান্ত্রিক জোট (এনডিএ) এর সাথে একত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে, যদিও তাদের আসন সংখ্যা গতবারের তুলনায় ব্যাপক হারে হ্রাস পেয়েছে।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দল বিজেপি 543 টি আসনের মধ্যে মাত্র 240টি আসন জিতেছে, যা একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজনীয় 272-সংখ্যার চেয়ে কম। যদিও বিজেপি তার মিত্রদের সাথে মিলে 293টি আসন পেয়েছে যা সরকার গঠনের জন্য পর্যাপ্ত।
তথাপি এই জয় বিজেপির কাছে কোন পরাজয়ের চেয়ে কম নয়। কারন বিজেপি গত ১০ বছর যেভাবে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ব্যাপক দাপটের সাথে সরকার চালিয়েছে এবং এবারের নির্বাচনে নিজেদের জন্য যে ধরনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল এই অর্জন তার কাছে কিছুই নয়। বিজেপির এই ভুমিধস পরাজয়ের পেছনে যে কারণগুলো কাজ করেছে এখানে আমরা তার বিশ্লেষণ করবঃ
1. বড় রাজ্যে খারাপ ফল
উত্তরপ্রদেশ (ইউপি) এবং মহারাষ্ট্রের মতো উল্লেখযোগ্য রাজ্যগুলিতে বিজেপি খারাপ পারফর্ম করেছে৷ ইউপি-তে, বিজেপি এককভাবে মাত্র 33টি এবং জোটগতভাবে মাত্র 36টি আসন জিতেছে, যা আগের নির্বাচনগুলির থেকে একটি উল্লেখযোগ্য পতন। মহারাষ্ট্রে, বিজেপি 48টি আসনের মধ্যে মাত্র নয়টিতে, পশ্চিম বঙ্গে ৪২ টি আসনের মাত্র ১২ টিতে জিতেছে। গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যগুলিতে এই প্রকার রক্তক্ষরণ বিজেপির প্রাপ্ত সামগ্রিক আসন সংখ্যাকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করেছে৷
2. বেকারত্ব এবং মূল্যস্ফীতির সমস্যা:
বিজেপির গত ১০ বছরের শাসনে বেকারত্ব সমস্যর উল্লেখযোগ্য কোন সমাধান হয় নি। উপরন্তু, গত কয়েক বছরে মহামারি এবং যুদ্ধের কারনে মূল্যস্ফীতি সমস্যার রাতারাতি অবনতি হওয়াতে মানুষের মনে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে।
3. আঞ্চলিক খেলোয়াড়দের উত্থান:
আঞ্চলিক দলগুলি যেমন ইউপিতে সমাজবাদী পার্টি (এসপি) এবং পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস (টিএমসি) উল্লেখযোগ্য লাভ ফল করেছে৷ ইউপিতে এসপি 37টি আসন জিতেছে, এবং পশ্চিমবঙ্গে টিএমসি 29টি আসন পেয়েছে। এই আঞ্চলিক খেলোয়াড়দের পুনরুত্থান এই রাজ্যগুলিতে বিজেপির আধিপত্যকে দুর্বল করে দিয়েছে।
4. পার্টির অভ্যন্তরীণ সমস্যা এবং দলত্যাগ:
বিজেপি তৃণমূল কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ এবং নির্বাচনী প্রচারে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) অংশগ্রহণের অভাব সহ অভ্যন্তরীণ সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিল৷ উপরন্তু, বিজেপিতে যোগদানকারী অন্যান্য দল থেকে আগত অনেক প্রার্থীই ভাল ফল করেনি যা দলের অবস্থানকে আরও দুর্বল করেছে।
5. কৃষক বিক্ষোভ এবং গ্রামীণ অসন্তোষ:
হরিয়ানা, রাজস্থান এবং পাঞ্জাবের মত কৃষিপ্রধান রাজ্যগুলিতে ব্যাপক কৃষক বিক্ষোভ দেখা দিয়েছে যা গ্রামীণ ভোটারদের মধ্যে বিজেপির বিশ্বাসযোগ্যতা কমাতে অবদান রেখেছে।
6. কর্তৃত্ববাদী প্রবণতার অভিযোগ:
মোদির সরকার ভারতের বৃহত্তম সংখ্যালঘু মুসলমানদের ভিন্নমতকে দমিয়ে রাখার এবং প্রান্তিক করার অভিযোগের সম্মুখীন হয়েছে৷ দলের ভেতরে এবং বাইরে ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদ মধ্যপন্থী এবং সংখ্যালঘু ভোটারদের বিচ্ছিন্ন করেছে।
৭. “আব কি বার, 400 পার” স্লোগান
মোদির ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং নির্বাচনী প্রচারে তার ব্যাপক ব্যবহার বিজেপির দিকে বুমেরাং হয়ে ফিরে এসেছে। বিজেপির স্লোগান “আব কি বার, 400 পার” (এবার, 400 টিরও বেশি আসন) যা সংবিধান সংশোধনের অনুমতি দেয় (দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা) ভোটারদের মধ্যে সম্ভাব্য সাংবিধানিক পরিবর্তনের আশঙ্কা তৈরি করেছে৷ বিশেষ করে যারা সংবিধানিক সুরক্ষার দ্বারা লাভবান হয়ে থাকে সেই সকল পিছিয়ে পরা মানুষের মধ্যে ভয়ের সঞ্চার করেছে।
8. COVID-19 এর প্রভাব:
COVID-19 মহামারীর কারনে অর্থনৈতি ধাক্কা খেয়েছে, মুদ্রাস্ফীতি এবং বেকারত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে যা বিজেপির ভাবমূর্তিকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছিল। মহামারীর প্রভাবে দেশের প্রায় সকল প্রান্তের মধ্যবিত্ত এবং দরিদ্র মানুষেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যার প্রতিক্রিয়ায় জনসাধারণের মনে পুঞ্জিভূত ক্ষোভ নির্বাচনী ফলাফলে ভূমিকা পালন করেছে।
9. অর্থনৈতিক ইস্যুতে বিরোধীদের ফোকাস:
বিরোধীরা কার্যকরভাবে বেকারত্ব এবং মুদ্রাস্ফীতির মতো অর্থনৈতিক বিষয়গুলিতে মনোনিবেশ করেছিল। এই জ্বলন্ত সমস্যাগুলোকে সামনে এনে তারা হিন্দু জাতীয়তাবাদ এবং মোদির ক্যরিস্ম্যাটিক ব্যক্তিত্বের হাওয়া সরিয়ে নিজেদের দিকে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল।
10. প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়া:
বিজেপি গত 10 বছর ক্ষমতায় থাকার পর, ভোটারদের ক্লান্তি ছিল। মোদির নেতৃত্ব এবং বিজেপির প্রতিশ্রুতি আগের নির্বাচনের মতো জোরালোভাবে অনুরণিত হয়নি। ভোটাররা দলের আবেগপূর্ণ বিষয়গুলির উপর নির্ভর না করে বর্তমানের বস্তুগত সমস্যাগুলোর সমাধানের উপর বেশি জোর দিয়েছিল।
11. অগ্নিবীর যোজনা:
সেনা সদস্যদের গড় বয়স কমানোর জন্য সরকার যে “অগ্নিবীর” নামক পরিকল্পনার ঘোষণা করেছে তার ফলে দেশের কিছু অঞ্চলের মানুষের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সঞ্চার করেছে। বিশেষ করে হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, পাঞ্জাব, হিমাচলের যুবকদের মদ্যে অনেকেরই স্বপ্ন থাকে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে ভবিষ্যৎ গড়ার। কিন্তু এই প্রকল্পের ফলে সেনায় নিয়োগ করা ২ তৃতীয়াংশ সদস্যকে ৪ বছর পরে বাহিনী থেকে অব্যাহতি দেয়া হবে এবং মাত্র ১ তৃতীয়াংশের চাকরিই স্থায়ী করা হবে।
12. বিরোধীদের দ্বারা নগদ অর্থ প্রদানের প্রতিশ্রুতি:
সরকার নগদ অর্থ এবং অন্যান্য উপহার দিলে কার না ভালো লাগে। বিশেষ করে দরিদ্র এবং মধ্যম বর্গের মানুষের মধ্যে এসব জনমহিনি প্রকল্পের ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে।
13. বিদেশী প্রভাব:
যেকোনো বড় এবং প্রভাবশালী দেশে জাতীয়তাবাদী সরকার ক্ষমতায় এলে অন্য কিছু দেশের অসন্তুষ্টির উদ্রেক হয়। এর কারন জাতীয়তাবাদী সরকার নিজ দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থকে সবার ওপরে রাখে, সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণের কথা বলে। আর এই আত্মমগ্নটা অন্য প্রভাবশালী দেশের প্রভাব বিস্তারে বাধা তৈরি করে। এর ফলে আন্তর্জাতিক লবি তৈরি হয়, প্রচার মাধ্যমে সরকারের ব্যর্থতাগুলোর ব্যপক প্রচার পায়, সমাজমাধ্যম ব্যবহার করে ভোটারদের মতামতকে প্রভাবিত করার চেষ্টা হয়।